টেলিসার্জারি
টেলিসার্জারি অথবা রিমোট-সার্জারি, এই কথাটি আজ প্রায়শই শোনা যায়, কিন্তু জিনিসটি আসলে কি সেটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। টেলিসার্জারি কথাটির সংজ্ঞা হল চিকিৎসকদের ক্ষমতা প্রদানকারী একটি পদ্ধতি যাতে তারা শারীরিকভাবে একই স্থানে উপস্থিত না থেকেও রোগীর উপর অস্ত্রোপচার করতে পারেন। উপরোক্ত কথাটি একটু আজব শুনতে লাগলেও, কথাটি কিন্তু আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী প্রযুক্তির চমকপ্রদ আবিস্কার। টেলিসার্জারির উত্থানের পশ্চাতে রয়েছে মূলত রোবোটিক্স এর সাফল্য। বিশ্বের প্রথম রোবট-চালিত অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত যন্ত্রটির নাম হল ‘da Vinci® Surgical System’ যেটি পরবর্তী ক্ষেত্রে টেলিসার্জারির মেরুদন্ড হয়ে ওঠে। একটি রোবোটিক্স অস্ত্রোপচার সিস্টেম সাধারণত এক বা একাধিক অস্ত্র (শল্যবিদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত), একটি মাস্টার নিয়ামক (কনসোল) এবং একটি সংজ্ঞাবহ সিস্টেম ব্যবহারকারীকে তার সম্বন্ধে ফীডব্যাক দান নিয়ে গঠিত। টেলিসার্জারির সাফল্যের আরও দুটি কারণ হলো উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং উন্নত তথ্য পরিচালনা মাধ্যম। টেলিসার্জারিতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে অ্যাসিঙ্ক্রোনাস ট্রান্সফার মোড -এর কথা বলা হয়েছে যার মূল ভিত্তি হলো সেল রিলে প্রযুক্তি যেটি ব্যবহার করে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্বর, চলমান-দৃশ্য, এবং তথ্য উচ্চ গতিতে স্থানান্তররিত করা যায়। সেল রিলে প্রযুক্তিতে কম্পিউটার বা নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের মধ্যে তথ্য স্থানান্তরের জন্য ছোট নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের প্যাকেট বা সেল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এবং এর মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত বেগে তথ্য স্থানান্তর করা যায়। টেলিসার্জারিতে তৃতীয় উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিটি হলো সংজ্ঞাবহ সিস্টেম অথবা হ্যাপটিক প্রযুক্তি| হ্যাপটিকস্ একটি স্পর্শ বিজ্ঞান, যেখানে হ্যাপটিক প্রতিক্রিয়া কোন ধরনের হাতের স্পর্শের বিরোধিতায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রদান করে। টেলিসার্জারিতে হ্যাপটিক প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি ভার্চুয়াল ছবি তৈরি করা হয়, যেটি শল্যবিদদের অনুভুতি দেয় যে অংশের উপরে তারা অস্ত্রোপচার করতে চলেছেন, তবে এই ব্যবস্থায় ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক-এর সময়-বিলম্ব খুবই সংবেদনশীল। টেলিসার্জারির ক্ষেত্রে রোবটের অবস্থান ঠিক অস্ত্রোপচারের অবস্থানে হয়ে থাকে এবং রোবটটি শল্যবিদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। টেলিসার্জারিতে মূলত শল্যবিদদের মধ্যে যোগাযোগটাই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে শল্যবিদ ও রোগীর মাঝে ভৌত দূরত্ব জরুরি নয়। টেলিসার্জারিতে প্রথম সত্য এবং সম্পূর্ণ দূরবর্তী অস্ত্রোপচারের করেন এক ফরাসি শল্যবিদ ডাঃ জ্যাক মারেস্ক ৭ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে। তিনি নিউ ইয়র্কে উপস্থিত থেকে ৬,২৩০ কিলোমিটার দূরে স্ট্রসবার্গ, ফ্রান্সে একটি ৬৮ বছর বয়সী মহিলা রোগীর টেলিসার্জারির মাধ্যমে গলব্লাডারের অপারেশন করেন, এটা লিন্ডেবার্গ অপারেশন হিসাবে পরিচিত। অপারেশন লিন্ডেবার্গ-এর সাফল্যের পরে টেলিসার্জারি অনেক স্থানে বহুবার পরিচালিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ডা: আনভারী, হ্যামিলটন, কানাডার একজন বিখ্যাত লাপারস্কপিক শল্যবিদ অনেক টেলিসার্জারি পরিচালিত করেছেন, যেখানে রোগীর অবস্থান হ্যামিলটন থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে ছিল। চিকত্সা বিজ্ঞানে টেলিসার্জারির প্রসার আজ মানুষকে যে শুধুমাত্র সময় অপচয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাই নয়, প্রত্যেক মানুষকে অভিজ্ঞ চিকিত্সক দ্বারা উন্নত চিকিত্সা পেতে সমর্থ করেছে। অপারেশন লিন্ডেবার্গ প্রমান করেছে যে প্রযুক্তি আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান হয়ে বিশ্বের প্রত্যন্ত এলাকায় সযত্নে উন্নত পরিষেবা প্রদান করে চলেছে। সৌজন্যে : জে মারেস্ক প্রভূত., "ট্রান্সআটলান্টিক রোবট সহায়তায় টেলিসার্জারি," Nature, vol. 413, pp. 379-380, 2001.